সর্বশ্রেষ্ঠ 20 টি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সমগ্র

কবিতাঃ গোপন প্রিয়া
কাব্যগ্রন্থঃ সিন্ধু হিন্দোল

পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি,
মধ্যে সাগরে, এ-পারে ও-পার করছি কানাকানি!
আমি এ-পার, তুমি ও-পার,
মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার
ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্ছানি,
আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁয়া খানি।

নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয় !
আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয় !
এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে
আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে,
আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়,
কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয় !

চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর ।
গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর ।
গান ফুরালো যাব যবে
গানের কথাই মনে রবে,
পাখী তখন থাকবে না ক’-থাকবে পাখীর ঘর,
উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর !

তোমার পারে বাজল কখন আমার পারের ঢেউ,
অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ।
উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে
একটি পালক প’ড়লে পথে,
ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও !
ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও !

বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি
ঝুরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী ?
মনের মনে নিশীথ-রাতে
চুমু দেবে কি কল্পনাতে ?
স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি !
মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী !

দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল !
কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল !
তোমায় পেলে থামত বাঁশী,
আসত মরণ সর্বনাশী ।
পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছ আমার বুকের কোল।
বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠছে বাঁশীর বোল ।

বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও,
দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও ।
থাকবে তুমি ছায়ার সাথে
মায়ার মত চাঁদনী রাতে !
যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও !
শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও !

ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর !
তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর ।
কোথায় আছ কেমনে রাণি
কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি!
ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর !
চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর !

রাত্রে যখন একলা শোব-চাইবে তোমার বুক,
নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ ।
দুখের সুরায় মস্ত্ হ’য়ে
থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে,
কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ !
ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ ।

গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান।
থামবে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান !
শিল্পী আমি, আমি কবি,
তুমি আমার আঁকা ছবি,
আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান ।
চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান ।

তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর,
কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির ।
গোপন তুমি আসলে নেমে
কাব্যে আমার, আমার প্রেমে,
এই-সে সুখে থাকব বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর ?
দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড় !

বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান,
মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান !
যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে
করবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে,
ভোলার মাঝে উঠবে বেজে, সেই তো আমার প্রাণ !
নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেলে গেলাম গান !